৭ম পঞ্চবার্ষিকী কর্মপরিকল্পনা, এসডিজি ও ডেলটা প্লানের আলোকে উপজেলা পর্যায়ে বুদ্ধিভিত্তিক পেশা বৃদ্ধিতে আইসিটির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিতকরণ। ই-কমার্স ও অন্যান্য ই-সার্ভিস নির্ভর সেবার প্রচলন ঘটানো।
২০৪১ সালে আমরা কেমন শিক্ষা ব্যবস্থা দেখব? শিক্ষার্থীরা কি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে? আর্টিফিশিয়াল ইন্টালিজেন্স (এআই) কি দখল করে নেবে শিক্ষকদের জায়গা? নাকি শিক্ষার সহায়ক হিসেবে কাজ করবে?
স্মার্ট বাংলাদেশের আগামীর শিক্ষার ছবিটা আঁকতে গেলে এই প্রশ্নগুলো ঘুরেফিরে উঁকি দেয়। গত ১৫ বছরে শিক্ষা খাতে অনেক পরিবর্তন দেখা গেছে, যেখানে স্কুলের পাঠ্যপুস্তকের ওপর নির্ভরতা কমে শিক্ষা হয়েছে বৈশ্বিক। শহর থেকে গ্রাম, পুরো বিশ্ব এখন চলে এসেছে হাতের মুঠোয়। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে শেখার সুযোগ ও পরিধি বিস্তৃত হয়েছে বেশ। মোবাইল ফোন হয়েছে জ্ঞান আহরণের মাধ্যম।
আগামীর স্মার্ট শিক্ষাটা কল্পনা করা হচ্ছে ঠিক সেভাবেই, যে শিক্ষাব্যবস্থায় শেখার কোনো দেয়াল থাকবে না। স্মার্ট শিক্ষা ইকোসিস্টেমে শিক্ষার্থীরা নিজের সমস্যার সমাধান নিজেই করবেন। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে একজন স্মার্ট নাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবেন। সেই শিক্ষাব্যবস্থায় নাগরিকরা হবেন বুদ্ধিদীপ্ত, দক্ষ, উদ্ভাবনী, সৃজনশীল, প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় জাগ্রত দেশপ্রেমিক এবং সমস্যা সমাধানের মানসিকতাসম্পন্ন। তাদের দক্ষতা উন্নয়নে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি ব্লেন্ডেড শিক্ষা, ডিজিটাল মাধ্যম, সমাজের সর্বস্তরে ডিজিটাল দক্ষতার উন্নয়ন, স্মার্ট ডিভাইসের ব্যবহার বৃদ্ধি ও স্মার্ট কর্মসংস্থান অগ্রাধিকার পাবে।
স্মার্ট শিক্ষার লক্ষ্য হচ্ছে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম ও উদ্ভাবনী একটি স্মার্ট প্রজন্মকে তৈরি করা। তাই বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষাক্রমও করা হচ্ছে যুগোপযোগী। শিক্ষার্থীরা শিখবে হাতে-কলমে, সমস্যা সমাধান করার মাধ্যমে। শুধু না বুঝে মুখস্থ করবে না। বরং পড়বে, বুঝবে এবং জীবনের নানা সমস্যার সমাধানে ভূমিকা রাখবে, গড়ে উঠবে বিশ্লেষণধর্মী মানসিকতাসম্পন্ন নাগরিক হয়ে। এই সুযোগ হবে শহর থেকে গ্রাম সবার জন্য সমান। থাকবে আধুনিক প্রযুক্তিতে দক্ষ হওয়ার সুযোগ। শেখার সুযোগ বৈশ্বিক হওয়ায় সব শিক্ষার্থীই নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরেও দেশ-বিদেশের নানান উৎস থেকে জানার ও শেখার সুযোগ পাবে।
স্মার্ট শিক্ষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তির সংমিশ্রণে ব্লেন্ডেড এডুকেশন পদ্ধতিতে শেখা, দক্ষতা অর্জন করা।
এটি শিক্ষার্থীদের নির্বিঘ্নে অনলাইন ও অফলাইনে শেখার সুযোগ তৈরি করে দেয়। ফলে একটি সহজ এবং ব্যক্তি উপযোগী শিক্ষার পরিবেশ তৈরি হয়।
আগামী দিনের শিক্ষার একটি বড় অংশজুড়ে থাকবে পারসোনালাইজড লার্নিং, যেখানে শিক্ষার্থীর আগ্রহ ও শিখন চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় কনটেন্ট থেকে নিজেই তার সুবিধা ও সময়মতো শিখে নিতে পারবে, দক্ষ হয়ে উঠতে পারবে। আর এখানে তাদের সহায়তা করবে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই)। শিখন ও দক্ষতার ঘাটতি পরিমাপ করে আগ্রহ ও চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের গাইড করার ক্ষেত্রে আগামীতে এআইয়ের বড় ভূমিকা থাকবে। সেই সঙ্গে ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং ও উপযুক্ত জব ম্যাচিংয়ের ক্ষেত্রেও এআই গাইড করতে পারবে। এতে একজন শিক্ষার্থী বৈশ্বিক চাহিদাকে মাথায় রেখে নিজেকে দক্ষতাসম্পন্ন করে তুলতে সক্ষম হবে। স্বাবলম্বী হয়ে নিজের কর্মসংস্থান তৈরি করবে। অন্যদেরও কর্মসংস্থান তৈরিতে অবদান রাখতে পারবে।
আমরা এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থার স্বপ্ন দেখে পরিকল্পনা করে যাচ্ছি যেখানে শিক্ষার্থী শুধু ডিজিটাল পদ্ধতিতেই শিখবে না, বরং তারা শিখবে বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের কাজ আমরা নিয়েছি বিভিন্ন উদ্যোগ। এর যাত্রা শুরু হয়েছিল মাল্টিমিডিয়া পদ্ধতিতে পাঠদান থেকে বর্তমানের গবেষণাধর্মী শিখন পদ্ধতিতে, যেখানে পাঠদান প্রক্রিয়া হবে আরও বাস্তবধর্মী। আমরা দেখেছি, কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারির সময় লাখ লাখ শিক্ষার্থী ক্লাসে যেতে না পেরে হতাশ হয়ে পড়েছিল। হতাশা ও উদ্বেগজনক সেই সময়টিতে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোর মাধ্যমে নানা শিক্ষামূলক উদ্যোগ আমাদের শিক্ষাকে চলমান রাখতে সহায়তা করেছে।
গ্রাম ও শহরে প্রত্যেকই সঠিক শিক্ষার আওতায় থাকবেন। সেজন্য প্রয়োজন অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থার ইকোসিস্টেম, যেখানে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ প্রসারিত হবে। অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থা গঠনেও সরকার দৃষ্টান্তমূলক ভূমিকা নিয়েছে যেন, একজন প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীও নিজেকে প্রস্তুত করে নিতে পারেন। বইয়ের অক্ষরের পাশাপাশি ছবির কথাও যেন উপলব্ধি করতে পারেন, সেটি নিশ্চিত করা হয়েছে। নিশ্চিত করা হচ্ছে, প্রযুক্তি যেন হয় প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য সহায়ক। মাল্টিমিডিয়া টকিং বইয়ের পাশাপাশি নানা উদ্ভাবনী প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষাকে সহজলভ্য করা হচ্ছে।
এখন প্রশ্ন জাগতে পারে, সবই শেখা নিয়েই বলা হলো, কিন্তু শেখানো নিয়ে তো কিছুই বলা হলো না। শিক্ষাবিজ্ঞানে শিক্ষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান শিক্ষক। একটি শিক্ষা ইকোসিস্টেমে শিক্ষকের ভূমিকা মুখ্য। আর তাই স্মার্ট শিক্ষাপদ্ধতি বাস্তবায়নে যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক তৈরির ওপরও জোর দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীদের চাহিদাগুলো আরও ভালোভাবে বোঝা ও সমাধানের জন্য শিক্ষকদের প্রযুক্তি ও যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রয়োজনীয় তথ্যনির্ভর হতে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
এআই কি শিক্ষকদের জায়গা নিয়ে নেবে? না। স্মার্ট শিক্ষার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হতে পারে এআইয়ের প্রয়োগ। শেখানো ও মূল্যায়নে শিক্ষকেরা এই প্রযুক্তিকে কাজে লাগাবেন, আর শিক্ষর্থীরা ব্যবহার করবে শেখার ক্ষেত্রে। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম হবে এআই ব্যবহারে পারদর্শী। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে এই প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবহারের মাধ্যমে তারা বাংলাদেশকে নিয়ে যাবে উন্নত বিশ্বের কাতারে।
আমরা যেই স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি, যেখানে স্মার্ট শিক্ষাব্যবস্থা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে এবং আমাদের পথ সুগম করে দেবে উন্নত দেশে রূপান্তরের ক্ষেত্রে। সহজলভ্য স্মার্ট ডিভাইস নিশ্চিতের মাধ্যমে শতভাগ মানুষের নিকট পৌঁছে যাবে স্মার্ট প্রযুক্তি। প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা সেবার আওতায় থাকবে দেশের প্রতিটি নাগরিক, যেখানে পিছিয়ে থাকবে না কেউ। এটি কোনো রূপকথার গল্প কিংবা অতিকথন নয়। এটি আশা ও অগ্রগতির আলোকবর্তিকা, যা আমাদের একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে পরিচালিত করছে। যাত্রা শুরু হয়ে গেছে, গন্তব্য অনেক কঠিন, তবে অসম্ভব নয়!
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস